প্রক্রিয়াজাত শিল্পের শতকোটি ডলার রফতানি আয়ের মাইলফলক অর্জন

প্রক্রিয়াজাত শিল্পের শতকোটি ডলার রফতানি আয়ের মাইলফলক অর্জন

Published on: 19th September, 2021

আয়তনে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এ দেশকে একসময় শুনতে হয়েছে তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ। কিন্তু বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী, ভৌগোলিক অবস্থান, উর্বর মাটি ও সঠিক সময়ে সঠিক নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। ২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম অর্থনৈতিক শক্তি। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস বলছে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বিকাশ অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সালে বাংলাদেশ হবে ২৫তম অর্থনৈতিক শক্তি।

২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে বাংলাদেশ এখন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরে কর্মরত মানুষ তাদের সবটুকু নিংড়ে দিয়ে দেশ গড়ার কাজ করে চলছে। এর মধ্যে কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প অন্য খাতগুলোর সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।

news

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি খাত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। জীবন-জীবিকার পাশাপাশি জাতির সার্বিক উন্নয়নে কৃষি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। প্রযুক্তির উদ্ভাবন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, বাণিজ্যিক উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাত শুরু হলে গত কয়েক দশকে দেশে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ে। যান্ত্রিক সভ্যতার যুগেও বাংলাদেশে শ্রমশক্তির প্রায় ৬০ ভাগ কৃষি খাতে নিয়োজিত। দেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান এখন ১৩ শতাংশের মতো হলেও কর্মসংস্থানের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এমনকি করোনা মহামারীর সময়ে জিডিপিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা সেবা ও শিল্প খাত কিছুটা নড়বড়ে পরিস্থিতিতে থাকলেও কৃষি খাত অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে বড় ভূমিকা রেখেছে।

আরো আনন্দের বিষয়, করোনা মহামারীর মধ্যে গত অর্থবছরে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার রফতানি আয়ের মাইলফলক অতিক্রম করেছে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাত। চলতি অর্থবছরেও সে ধারা অব্যাহত রয়েছে।

অথচ স্বাধীনতার পর সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উল্লেখ করার মতো একমাত্র শিল্প ছিল পাট শিল্প। এরপর পর্যায়ক্রমে গড়ে উঠতে শুরু করে তৈরি পোশাক শিল্প, কৃষিভিত্তিক শিল্প, হালকা প্রকৌশল শিল্প, ওষুধ শিল্প, চামড়া শিল্প, জাহাজ ভাঙা ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পসহ বহু শিল্প।

কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প দেশের অর্থনীতিতে এরই মধ্যে শক্ত একটি জায়গা তৈরি করে ফেলেছে। এছাড়া দেশের হয়ে রফতানির অন্যতম খাত হয়ে ওঠা এ শিল্প বিশ্বদরবারেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। এ খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশের ‘প্রাণ’। বাংলাদেশের প্রাণ এখন বিশ্বের ১৪৫টি দেশে পৌঁছে গেছে। বিশ্বের এমন কিছু দেশ আছে যেখানে বাংলাদেশের দূতাবাস নেই, কিন্তু প্রাণ সেখানে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছে। রফতানিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখায় প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ সরকারের কাছ থেকে পরপর ১৬ বার জাতীয় রফতানি ট্রফি পেয়েছে। এছাড়া চলতি বছর সরকার কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাতে রফতানি ট্রফি দেয়ার জন্য যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা করেছে তার সবই পাচ্ছে প্রাণের সহযোগী প্রতিষ্ঠান।

প্রাণ-আরএফএল পরিবার আজ বেশ সমৃদ্ধ। বর্তমানে প্রাণের ১০ ক্যাটাগরিতে প্রায় ২ হাজার ৮০০ পণ্য রয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাণের কারখানা রয়েছে যেখানে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ব দরবারে। প্রাণ কারখানাগুলো করেছে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায়, যাতে স্থানীয় মানুষ বেশি করে কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়। এই পথচলায় এখন গ্রুপে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার শ্রমিক সরাসরি কাজ করছে, যা বেসরকারি পর্যায়ে সর্বোচ্চ। বর্তমানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গ্রুপের ওপর নির্ভরশীল প্রায় ১৫ লাখ মানুষ।

প্রাণ-আরএফএল পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে গর্ব হয় যখন দেখি বাংলাদেশের প্রাণপণ্য আফ্রিকার বাহামার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন ব্যক্তির বাজারের ব্যাগে বা ওশেনিয়া দ্বীপপুঞ্জের দেশ ফিজি, ভানুয়াতু বা সলোমন দ্বীপপুঞ্জে কোনো ব্যক্তির হাতে। ভালো লাগে যখন দেখি আমার বাবার স্বপ্ন মানুষের হূদয়ে স্থান করে নেয়া প্রাণের পণ্য বিভিন্ন দেশের নামিদামি ব্র্যান্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বিশ্বের বিখ্যাত সব চেইনশপে। কানাডায় ওয়ালমার্ট, সৌদি আরব ও ওমানে ক্যারিফোর, যুক্তরাজ্যে পাউন্ডল্যান্ড, ভারতে রিলায়েন্স ফ্রেশ ও সিটি মার্ট, কাতারে গ্র্যান্ড মল ও আনসার গ্যালারি, সিঙ্গাপুরে জায়ান্ট ও শিং শিয়ং এবং মালয়েশিয়ায় টেসকো, এইওন ও সেগি ফ্রেশে একজন ক্রেতার বাজারের ট্রলিতে যখন আর ৮-১০টা পণ্যের মধ্যে প্রাণ ফ্রুটো স্থান পায় তখন মনে হয় বাবার দেখানো পথে ব্যবসায় আমার প্রবেশ অনেকটা সার্থক। পর্যটক হিসেবে যখন কোনো বাংলাদেশী ভারত, নেপাল, ভুটান কিংবা ইউরোপে ঘুরতে যান কিংবা একজন প্রবাসী বাঙালি যখন বাংলাদেশের প্রাণপণ্য খুঁজে পান, তখন প্রাণের প্রতি তার যে অনুভূতি কাজ করে, সেটিই বিদেশের মাটিতে আমাদের পথচলার এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।

আমাদের পথচলা শুরু হয় ১৯৮১ সালে, টিউবওয়েল ও কৃষিসহায়ক যন্ত্রপাতি তৈরির মাধ্যমে। এরপর কৃষিপণ্য উৎপাদনে আগ্রহী হই আমরা। ১৯৮৫ সালে নরসিংদীতে স্বল্প পরিসরে কলা, পেঁপে, আনারস, রজনীগন্ধা ইত্যাদি চাষ শুরু করি। এর মাধ্যমেই যাত্রা এগ্রিকালচারাল মার্কেটিং কোম্পানি লিমিটেড, তথা প্রাণের।

কৃষিপণ্য উৎপাদন করতে গিয়ে দেখি, দেশে অনেক পণ্য উত্পন্ন হলেও মৌসুমের সময় পণ্যের দাম কমে যায় এবং ন্যায্যমূল্য থেকে কৃষক বঞ্চিত হন। এছাড়া সংরক্ষণের অভাবে প্রচুর ফসল নষ্ট হয়ে যায়। তাই কৃষিপণ্য উৎপাদনের চেয়ে বরং প্রক্রিয়াকরণে উদ্যোগী হই। ১৯৯৩ সালে নরসিংদীতে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করার জন্য একটি কারখানা স্থাপন করি। সেখানে বিভিন্ন ফলের জুস, শাকসবজি প্রক্রিয়াজাত করা শুরু হয়। এভাবে বিভিন্ন ড্রিংকস, সস, জেলি, চানাচুর, চিপস, চকোলেট, বেকারি, দুগ্ধজাত পণ্য বাজারজাত শুরু করি।

বাংলাদেশের মাটি যেকোনো ফসল ফলানোর জন্য অত্যন্ত উর্বর। কৃষকদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ করতে গিয়ে আমরা তাদের মধ্যে দক্ষতার ঘাটতি ও প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব লক্ষ করলাম। আমরা চুক্তিভিত্তিক চাষ শুরু করলাম। চুক্তিভিত্তিক চাষের আওতায় আমরা তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, উন্নতমানের বীজ, সার, কৃষি উপকরণ দিয়ে সহায়তা দিতে শুরু করলাম। এতে অধিক পণ্যের সঙ্গে সঙ্গে মানসম্মত পণ্য পেতে শুরু করলাম। বর্তমানে প্রাণের এক লাখ চুক্তিভিত্তিক কৃষক রয়েছে যাদের কাছ থেকে নিয়মিত আম, টমেটো, বাদাম, চাল, ডাল, আনারস, পেয়ারা, হলুদ, মরিচসহ বিভিন্ন পণ্য সংগ্রহ করছি।

দেশে বড় সম্ভাবনাময় একটি শিল্প হচ্ছে দুগ্ধ শিল্প। এক সময় দেশের মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে প্রচুর পরিমাণ গুঁড়ো দুধ বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। আমরা দুগ্ধ খাতের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে দেশে প্রথম ডেইরি হাব পদ্ধতি চালু করলাম। এ ডেইরি হাব থেকে খামারিদের পরিচর্যা ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এতে যেমন গাভীপ্রতি দুধের উৎপাদন বেড়েছে, তেমনি খামারিদের জীবন-মানে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এখন প্রাণের এমন কয়েকজন খামারি রয়েছে যাদের একটি গাভী গড়ে প্রায় ৩০ লিটার দুধ দিচ্ছে। এটিকে আমাদের লক্ষ্য পূরণে আলোকবর্তিকা বলে মনে করি। তবে লক্ষ্যে পৌঁছোনোর পথ এখনো বহুদূর। আমরা যেদিন গাভীর ভালো জাতের উন্নয়ন ঘটাতে পারব, নিউজিল্যান্ড কিংবা ইসরায়েলের মতো গাভীপ্রতি প্রায় ৬০ লিটার দুধ সংগ্রহ করতে পারব, সেদিন আমরা দেশে সহজেই পুষ্টির জোগান দিতে পারব। আমাদের প্রাণ ডেইরি পরিবার এ লক্ষ্যে কাজ করছে। বর্তমানে প্রাণের চুক্তিভিত্তিক দুগ্ধ খামারি রয়েছে ১২ হাজার, যাদের কাছ থেকে আমরা প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করছি। এ খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আরো বড় আকারে অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে, কারণ দুগ্ধ শিল্পে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। এক্ষেত্রে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

আধুনিক কৃষির অন্যতম খাত হিসেবে পোলট্রি শিল্প ক্রমেই দেশের পুষ্টি চাহিদা জোগান, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে। এ শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রাণ এ খাতে কাজ করছে। হিমায়িত ফ্রোজেন প্রোটিন পণ্য বিদেশে রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি প্রচুর কর্মসংস্থান হচ্ছে। কৃষক ও সাধারণ মানুষকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এসব শিল্প বর্তমান সময়ে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে বড় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের এমন গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে পারাটা নিঃসন্দেহে বড় সৌভাগ্যের বিষয়।

স্বাধীনতার ঠিক পরে ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। এখন আবাদি জমি কমেছে ২০-৩০ শতাংশ। অথচ দেশে এখন খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে তিন-চার গুণ বেশি। স্বাধীনতার ৫০ বছরে কৃষি খাতে অনেক অর্জন এসেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), বাংলাদেশ ব্যাংক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোসহ (ইপিবি) বেশ কয়েকটি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ। আমরা দিনাজপুর, রংপুরসহ উত্তরবঙ্গের কৃষকদের সঙ্গে ধান উৎপাদনে কাজ করছি এবং সেখানে কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছি।

 

সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয়। আমরা সবজিজাত বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করে বিদেশে রফতানি করছি। এমনকি সরাসরি সবজিও রফতানি করছি। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ ষষ্ঠ। আমরা কৃষকদের কাছ থেকে প্রচুর আলু সংগ্রহ করছি। আমরা আমাদের নিজস্ব চেষ্টায় যতটুকু পারছি তা সংগ্রহ করে চিপস ও আলুজাতীয় পণ্য তৈরি করছি। বিদেশে এ ধরনের পণ্য রফতানি করে সফলও হচ্ছি। আলু থেকে আমাদের একটি নতুন উদ্ভাবন প্রাণ পটেটো বিস্কুট, যা বিদেশে রফতানি হচ্ছে। এটি অত্যন্ত আনন্দের যে এ পণ্য ভারতসহ কয়েকটি দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ভারতে রীতিমতো পণ্যটি নিয়ে সাড়া পড়েছে। এভাবে আমরা দেশীয় আলুতে মূল্যসংযোজন করে বাজার সৃষ্টিতে কাজ করছি।

দেশে এখন আম ও কাঁঠালের ভালো ফলন হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন আম উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম। একটা সময় ছিল গুটি আম চাষীরা ফেলে দিত। কিন্তু আমরা এ থেকে জুস ও ড্রিংক উৎপাদনে আম সংগ্রহ শুরু করলাম ও কৃষকদের বাণিজ্যিকভাবে আম চাষে অনুপ্রেরণা দিতে থাকলাম। এখন প্রাণ প্রতি বছর আমচাষীদের কাছ থেকে আম সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করার পর জুস ও ড্রিংক, ম্যাংগোবার রফতানি করছে। প্রাণের রফতানীকৃত ১৪৫টি দেশেই আমের জুস ও ড্রিংকস রফতানি হয়ে থাকে।

এগুলো যদি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রক্রিয়াজাত শিল্পের সঙ্গে তুলনা করি, তবে আমরা সেসব দেশ থেকে অনেক অনেক পিছিয়ে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা অনুযায়ী, প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণের অভাবে বাংলাদেশে প্রতি বছর মোট উৎপাদনের ৩০ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বেশ অগ্রগামী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে থাইল্যান্ড কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে অনেক এগিয়ে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প দেশটির তৃতীয় বৃহৎ শিল্প খাত। দেশটির মোট জিডিপির শতকরা ২৩ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। দেশটি প্রতি বছর কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রফতানি করে থাইল্যান্ড ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে। যেখানে বাংলাদেশে কৃষিপণ্যের মাত্র ১ শতাংশ প্রক্রিয়াজাত হয়। অন্যদিকে ভিয়েতনামে ৫ শতাংশ, চীনে ৩৮, ফিলিপাইনে ৩১, আমেরিকায় ৭০, থাইল্যান্ডে ৮১ ও মালয়েশিয়ায় ৮৪ শতাংশ কৃষি প্রক্রিয়াজাতের সঙ্গে জড়িত। অথচ কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পকে অধিক গুরুত্ব দিতে পারলে তৈরি পোশাক খাতের পরই কৃষি প্রক্রিয়াকরণ পণ্য রফতানির সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এটি হতে পারে দেশের দ্বিতীয় প্রধান রফতানি খাত।

তাই এখনই আমাদের এ খাতকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা এখন এক বিলিয়নে পৌঁছে গেছি। এটি শুরু মাত্র। আরো দীর্ঘপথ পাড়ি দেয়ার সুযোগ আমাদের সামনে রয়েছে। আমাদের সুযোগ রয়েছে থাইল্যান্ড, চীন, ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়ার মতো হওয়ার। বর্তমানে আমরা যেভাবে পণ্য রফতানি করছি সেখান থেকে আগামী দিনে আরো ভালো করতে হলে রফতানি বহুমুখীকরণ করতে হবে এবং কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে রফতানি পণ্যের সংখ্যা বাড়াতে হবে। আমরা এখন সরাসরি সবজি রফতানি করছি। চাইলে ক্যানিং সবজি, প্রক্রিয়াজাত রেডি সবজি, প্রয়োজনীয় সবজির জুস, স্ন্যাকস, বীজ আকারে বিদেশে রফতানি করতে পারি। আমরা ফলের ক্ষেত্রে সরাসরি ফল কিংবা শুধু জুস ও ড্রিংক আকারে রফতানি করি। কিন্তু আমরা মূল্য সংযোজন করে জ্যাম ও জেলি, ফলকে ক্যানিং করে ফ্রোজেন ফল আকারে কিংবা ফলের পাউডার আকারে রফতানি করতে পারি। কাঁঠাল, আনারস, কলা, পেয়ারাসহ বিভিন্ন ফলে মূল্য সংযোজন করে রফতানি বৃদ্ধি করা সম্ভব। আমরা শস্য জাতীয় ফসল শুধু গুঁড়া মসলা কিংবা শুকনা খাবার যেমন বিস্কুট, টোস্ট হিসেবে রফতানি করি। কিন্তু এগুলো পাউডার করে, সবজি আকারে, প্রসেস রেডি ফুড আকারে যেমন স্নাকস, নুডলস, পাস্তা, পিঠা, কেক ও বেকারি আইটেম করে রফতানি করলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে।

এভাবে আমরা বিদ্যমান পণ্যের বাইরে বিভিন্ন ধরনের দুগ্ধপণ্য, মিষ্টান্ন, মাছ ও প্রোটিন আইটেমে মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারি। এগুলোর রফতানি বাজার সম্প্রসারণ করতে উদ্যোক্তাদের তীব্র ইচ্ছাশক্তি প্রয়োজন। নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধান ও নতুন নতুন পণ্য নিয়ে বাজার সৃষ্টি করতে পারলে এক্ষেত্রে রফতানি বাড়বে। তবে কিছু প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পারলে এবং সরকারি পর্যায়ে কিছু নীতিসহায়তা পেলে এ খাত দেশের অর্থনীতিতে বিশাল অবস্থান তৈরি করতে পারবে বলে বিশ্বাস রাখি। এক্ষেত্রে প্রথমেই আসে ফিসক্যাল পলিসিগত কিছু বিষয়। দেশে খাদ্যপণ্যের কারখানা নির্মাণে বেশ কিছু বিষয়ে নীতি সহায়তায় দিলে এ খাত ভালো করবে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি বরাদ্দ সহজলভ্য না হওয়া, কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য রফতানির জন্য বিশেষ ক্যাশ ইনসেনটিভ না থাকা, যা বর্তমানে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য রয়েছে, বাণিজ্যের জন্য লাইসেন্স পেতে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও চুক্তির নবায়ন সহজলভ্য না হওয়া, রফতানি বাণিজ্য বাড়াতে সম্ভাব্য দেশগুলোতে কান্ট্রি ব্র্যান্ডিংয়ের ঘাটতি, দেশে আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবের তৈরি না হওয়া, অর্গানিক ও মানসম্মত কাঁচামাল উৎপাদনে কৃষকদের প্রশিক্ষণের ঘাটতি, কম জমিতে অধিক ফলন পেতে কৃষকদের নীতি সহায়তা—এসব প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কাজ করা জরুরি।

দ্বিতীয়ত, আর্থিক চ্যালেঞ্জ। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ব্যাংকঋণ সহজলভ্য না হওয়ায় নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাইরে বিনিয়োগে ট্যাক্স হলিডে সুবিধা না থাকা, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক মুক্ত সুবিধা না থাকা, কৃষি উপকরণ যন্ত্রের দাম বেশি হওয়া, পণ্য রফতানিতে মাদার ভ্যাসেলের উচ্চমূল্য, কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি, কৃষকদের জন্য কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা না থাকা এবং কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য পরিবহনে আর্থিক সহায়তা না থাকা। এসব সমস্যার সমাধানে কাজ করলে বিদ্যমান উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি নতুনরাও ভালো করবে।

তৃতীয়ত, উদ্যোক্তাদের জন্য কারখানায় ইউটিলিটি সাপোর্ট সহজলভ্য করা। এরপর রয়েছে অবকাঠামো সমস্যা, যা দূর করা দরকার। পঞ্চম রফতানি বাণিজ্য বাড়াতে দরকার বিভিন্ন ধরনের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি। বাণিজ্য বাড়াতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে হবে। বিশেষ করে আফ্রিকা, আশিয়ান ও সার্কভুক্ত দেশগুলো কৃষি এবং কৃষিজাত পণ্য রফতানির জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। এসব অঞ্চলে শুল্ক মুক্ত পণ্য প্রবেশে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্য বাধা দূর করতে সরকারকে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে ভারত, নেপাল, ভুটান খাদ্যপণ্যের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময় বাজার। এখানে বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করতে হবে।

প্রাণ গ্রুপ বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কৃষকের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে এবং নিত্যনতুন পণ্য নিয়ে বিশ্বদরবারে হাজির হচ্ছে। এই ‘প্রাণ’ বিদেশে বাংলাদেশের প্রাণ হয়ে উঠছে। আমরা বিশ্বাস করি, প্রাণের হাত ধরে কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প দীর্ঘপথ পাড়ি দেবে এবং বিশ্বের আনাচে-কানাচে বাংলাদেশের কৃষকের উৎপাদিত পণ্য প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে পৌঁছে যাবে।